তখন ইন্টারনেট বা অনলাইন ছিল না। ২০০০-২০০২ সালের কথা। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয়-আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংবাদের জন্য রেডিও ও টেলিভিশনই ভরসা। মফস্বল জেলার দৈনিক পত্রিকাগুলো স্থানীয় খবরের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদও প্রকাশ করত। রেডিও, টিভির রেকর্ড করা খবর শুনে শুনে দায়িত্বপ্রাপ্ত রিপোর্টার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ তৈরি করতেন। আমরাও দৈনিক পলাশের জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিবিসি, বিটিভি ও একুশেটিভির খবর রেকর্ড করে রাখতাম। পরে সেই খবর শুনে সংবাদ তৈরি করতে হত, এটাকে সম্ভবত ‘মনিটরিং’ করা বলত। এই মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পালন করতেন হামিদ ভাই মানে অ্যাড. মো. আব্দুল হামিদ।
হামিদ ভাই বয়সে আমার অনেক বড়। কিন্তু তবুও তিনি আপনি সম্বোধন করতেন। আমি দৈনিক পলাশের নির্বাহী সম্পাদক আর হামিদ ভাই স্টাফ রিপোর্টার। খবর মনিটরিংয়ের কাজ ছাড়াও তিনি মাঝে মাঝে আদালতে মামলা সংক্রান্ত নিউজ করতেন। নিউজ করে তিনি কিন্তু তা ছাপানোর জন্য চাপ দিতেন না। আমার কাছে তা জমা দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলতেন, বাবু দেখেন তো নিউজটা ছাপা যায় কি না। হামিদ ভাইয়ের মত এত অমায়িক, বিনয়ী মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি।
আমি তখন দুহাতে লেখি, রিপোর্ট লেখার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিবন্ধ, মুক্তগদ্য বা মন্তব্য ধরনের লেখা। প্রায় প্রতিদিন উপ-সম্পাদকীয় বা মন্তব্য প্রতিবেদন বা সংবাদ প্রতিবেদন আমার নামে পত্রিকায় ছাপা হয়। হামিদ ভাই সেসব লেখার একনিষ্ঠ পাঠক, খুঁটেখুঁটে পড়েন। পত্রিকার সম্পাদক আনোয়ার ভাই (মো. আনোয়ার হোসেন) বিট পিয়নকে বলে দিয়েছিলেন সকাল বেলায় পাঠকদের সাথে পত্রিকার সব সাংবাদিকের বাড়িতেও যেন পত্রিকা পৌঁছে যায়।
হামিদ ভাই প্রায়দিনই অফিসে এসে বলতেন বাবু আপনার লেখাটা খুব ভালো হয়েছে। আরে ভাই, আপনি অনেক মেধাবি মানুষ, কেন আপনি গাইবান্ধায় পড়ে আছেন, আপনি ঢাকায় যান, ওখানে সাংবাদিকতা করেন, একদিন বড়মাপের সাংবাদিক হবেন। মাঝে মাঝেই তিনি জেদ ধরতেন আপনি কবে ঢাকায় যাবেন বলেন তো?
সাংবাদিকতা ছিল হামিদ ভাইয়ের ভালোবাসা ও আবেগের জায়গা। তবে তিনি এটাও বুঝতেন, মফস্বল জেলায় শুধু সাংবাদিকতা করলেই পেটে ভাত হবে না। তাই তিনি জীবিকার জন্য আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। জটিল আইন পেশায় জড়িত থেকেও কোর্ট থেকে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেই ঠিক সময়ে চলে আসতেন পলাশ অফিসে। সাংবাদিকতার প্রতি তাঁর ছিল গভীর আবেগ।
বিবিধ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আমি দৈনিক পলাশ ছেড়ে দিলে হামিদ ভাইও চলে যান। এরপর মাঝে মাঝে দেখা হলে আবেগে জড়িয়ে ধরতেন আর সেই পুরানো অভিযোগ করতেন, বাবু আপনি ঢাকা গেলেনই না! তাঁর সাথে একেবারেই যোগাযোগ ছিল না বহুদিন। কিছুদিন আগে বাবু ভাইয়ের (গাইবান্ধা অ্যাডভোকেট বার অ্যাসোসিয়েশনের শ্রদ্ধেয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. সিরাজুল ইসলাম বাবু) ফেসবুক পোস্টে দেখলাম হামিদ ভাই অসুস্থ। আবার তাঁর পোস্টেই জানলাম হামিদ ভাই আর নেই। দুর্ভাগ্য আমার! এই ভালো মানুষটার সাথে আমার আর দেখাই হল না। ক্ষমা করবেন হামিদ ভাই, আপনার পরামর্শ অনুযায়ী ঢাকায় গিয়ে বড় সাংবাদিক হওয়া হয়নি আমার।